রামিমের ক্লাসপ্রেম
প্লে থেকে দশম শ্রেণি। টানা ১২ বছর।
এক দিনও বিদ্যালয়ে অনুপস্থিতি নেই তার। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, পারিবারিক সমস্যা, এমনকি রোগব্যাধি উপেক্ষা করেও নিয়মিত ক্লাসে হাজির। পড়ালেখার প্রতি ভালোবাসা, প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তি ও পরিবারের উৎসাহে এক দিনও ক্লাস কামাই না করে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে ঝালকাঠির এক ছাত্র। তার নাম কে এম রাইদ ইসলাম রামিম। সে নলছিটি মার্চেন্টস মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয় অ্যান্ড কলেজ থেকে এ বছর এসএসসি পরীক্ষা দেবে।
রামিম ঝালকাঠির নলছিটি শহরের ব্যবসায়ী কে এম মোস্তাক খানের ছেলে। তার মা গৃহিণী নাজমা আক্তার। ক্লাসে শতভাগ উপস্থিতির কারণে বিদ্যালয় থেকে সে একাধিক পুরস্কার ও সনদপত্র পেয়েছে। তাকে শিক্ষার্থীদের ‘অনুকরণীয় আদর্শ’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন তার শিক্ষকরা।
জানা গেছে, রামিমের জন্ম ২০০১ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর। ২০০৫ সালের জানুয়ারিতে নলছিটি পৌর কিন্ডার গার্টেনে প্লে ক্লাসে ভর্তি করা হয় তাকে। প্লে ক্লাসে এক বছরে টানা উপস্থিতি ছিল তার। পরে নার্সারি ক্লাসেও শতভাগ উপস্থিতি। দুই বছরের টানা উপস্থিতির কারণে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে দুটি পুরস্কার দেয়। এতে শ্রেণিকক্ষের প্রতি তার আগ্রহ আরো বেড়ে যায়। ২০১১ সালে ওই কিন্ডার গার্টেন থেকে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নেয় এবং ওই প্রতিষ্ঠান থেকে একমাত্র ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পায় সে। সেই কিন্ডার গার্টেনে শতভাগ ক্লাসে উপস্থিতির জন্য সাত বছরে সাতটি পুরস্কার দেওয়া হয় তাকে। এক নাগারে সাত বছর টানা শতভাগ ক্লাসে উপস্থিতি ও ২০১১ সালে ওই কিন্ডার গার্টেন থেকে একাই ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি লাভ করায় তত্কালীন অধ্যক্ষ অ্যাডভোকেট আনিচুর রহমান খান হেলাল তাকে বিশেষ পুরস্কার (ক্রেস্ট) ও সনদপত্র প্রদান করেন।
২০১২ সালে রামিম নলছিটি মার্চেন্টস মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয় অ্যান্ড কলেজে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়। সেখানেও নিয়মিত ক্লাস শুরু করে। এরই মধ্যে তার বাবা ও মা ভারত যেতে তার জন্য পাসপোর্ট ও ভিসা সংগ্রহ করেন। কিন্তু বেঁকে বসে সে। ক্লাসে নিয়মিত উপস্থিত থাকার কারণে তার ভারত ভ্রমণে যাওয়া হয়নি। নিয়মিত ক্লাসে উপস্থিতির পাশাপাশি ২০১৪ সালে জেএসসি পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পায় সে। গত ১২ বছরের মধ্যে তার নানা, মামা ও চাচার মৃত্যু হয়েছে, তবু তার ক্লাস কামাই হয়নি। গত ৬ অক্টোবর স্কুলজীবনের শেষ ক্লাসে অংশ নিয়ে সে টানা ১২ বছর শতভাগ ক্লাসে উপস্থিতির রেকর্ড গড়ে। আগামী ২ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠেয় এসএসসি বিজ্ঞান বিভাগ থেকে অংশ নেবে রামিম। প্লে থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ১ থেকে ৩ এর মধ্যে ঘোরাফেরা করেছে তার রোল নম্বর। ভবিষ্যতে বুয়েটে পড়ার আগ্রহ তার।
রামিম কালের কণ্ঠকে বলে, ‘আমি যখন বুঝতে পারলাম শ্রেণিকক্ষে উপস্থিতিই ভালো ফলাফলের একমাত্র মাধ্যম, তখন থেকেই প্রতিজ্ঞা করেছি, যত দিন পড়ালেখা করব এক দিনও ক্লাস বন্ধ দেব না। ক্লাসে ঠিকমতো পড়ালেখা করলে প্রাইভেট পড়তেও হয় না। প্রতিদিন ক্লাসে আসার কারণে শিক্ষকরাও আমাকে ভালোবাসেন। আমাকে দৃষ্টান্ত দেখিয়ে অনেক সহপাঠীকে বিদ্যালয়ে নিয়মিত আসার জন্য বলেন। আমি ভবিষ্যতে উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য বুয়েটে লেখাপড়া করতে চাই। আমি যত দিন শিক্ষার্থী থকব, তত দিনই সব ক্লাসে উপস্থিত থাকব। ’
রামিমের বাবা কে এম মোস্তাক খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘রোগব্যাধি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সিডর, আয়লা মহাসেনসহ প্রতিকূল আবহাওয়ার মধ্যেও রামিম নিয়মিত নিজ উদ্যোগে আমাদের অনুপ্রেরণায় বিদ্যালয়ে উপস্থিত হতো। এ জন্য দীর্ঘ এক যুগ শতভাগ ক্লাসে উপস্থিতির রেকর্ড গড়তে পেরেছে। তার এ বিরল কৃতিত্বের বিষয়টি দেশের সব শিক্ষার্থীকে জানিয়ে তাদের উদ্বুদ্ধ করা যেতে পারে। ’
রামিমের মা নাজমা আক্তার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সারাক্ষণ পড়ালেখার মাঝেই ডুবে থাকতে পছন্দ করে রামিম। স্কুল ছুটি হলে বিদ্যালয়ে পাঠদান, শিক্ষক ও সহপাঠীদের নিয়ে আমার কাছে গল্প করত। একদিন ক্লাস বন্ধ দেওয়া মানে তার কাছে সব কিছু হারানোর মতো একটি বিষয় ছিল। তাই আমরাও তাকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কখনো জোর খাটাইনি। ’
নলছিটি পৌর কিন্ডার গার্টেনের সাবেক অধ্যক্ষ আনিচুর রহসান খান হেলাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘রামিম একজন মেধাবী শিক্ষার্থী। টানা ১২ বছর সে কখনো ক্লাসে অনুপস্থিত হয়নি। একটি বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী এই ছেলে যেকোনো কর্মস্থলে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে সফলতা আনতে পারবে। তার এ কৃতিত্বের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে তাকে সম্মাননা এবং পুরস্কৃত করা উচিত। তাহলে অন্য শিক্ষার্থীদেরও ক্লাসে উপস্থিতির প্রতি আগ্রহ বাড়বে। ’
নলছিটি মার্চেন্টস মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয় অ্যান্ড কলেজের প্রধান শিক্ষক মো. রেজাউল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমার শিক্ষক জীবনে রামিমের মতো একটি ছাত্রও চোখে দেখিনি যে টানা ১২ বছর শ্রেণিকক্ষে উপস্থিত ছিল। এটি একটি বিরল ঘটনা। সে পড়ালেখায়ও ভালো, মেধাবী শিক্ষার্থী। এসএসসিতে সে জিপিএ ৫ পাবে, এমনটাই আশা করছি। আমরা কৃতী এ শিক্ষার্থীকে টানা ১২ বছর শ্রেণিকক্ষে উপস্থিতির জন্য শিগগিরই পুরস্কার দেব। তার জন্য সব সময় আমাদের শুভ কামনা থাকবে। ’